পরিবর্তিত বাংলাদেশ। তাই ঢাকার মাটি ছোঁয়ার আগে একরাশ কৌতূহল ও উত্তেজনা ছিলই। দুরুদুরু বুকে অভিভাসন শেষে হজরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নির্বিঘ্নে গাড়িতে চেপে পুরান ঢাকা যাওয়ার পথে চালক সেলিমই প্রথম দেখালেন, ‘শাঁখা-পলা পরা বৌদিদের’। সঙ্গে অভয়বাণী, ‘কোনও ভয় নেই। এখানে হিন্দুরাও ভালোই আছেন’! চোখে পড়ল বহু ‘শাঁখা-পলা পরা বৌদিদের’।
হ্যাঁ, বাংলাদেশের বিবাহিত হিন্দু মহিলারা প্রায় সকলেই এখনও শাঁখা পরেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি টানা ৯ দিন। ফিরেও এসেছি নির্বিঘ্নে। কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। উড়াল পুল আর মেট্রো রেলের হাত ধরে যানজট অনেকটাই কম অনুভূত হয়েছে এবার। জনজীবন স্বাভাবিক। প্রাচীরের গায়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী দেওয়াল লিখন বাদ দিলে, পরিবর্তনের তেমন কোনও ছাপ ঠাহর হয়নি।
৩২ ধানমন্ডি শুধু থমথমে। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাওয়ার পথ বন্ধ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেওয়াল লেখা, ‘প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়’, আগের মতোই সতর্ক প্রহরা। তবে রাষ্ট্রপতির বাসভবন ‘বঙ্গভবন’-এর সামনে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ির বহর অতীতে চোখে পড়েনি। আরেকটি পরিবর্তন অনুভূত হয় শহরের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সেটি হলো অস্থিরতা। কাল কী হবে, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তার চিহ্ন স্পষ্ট সর্বত্র।
বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত থেকে শুরু করে সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সকলের মনেই দাগ কেটেছে অনিশ্চয়তার মোটা প্রলেপ। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশে স্বাচ্ছন্দের মধ্যেও সেই অনিশ্চয়তার থাবা ঢাকছে না। সবার মনেই প্রশ্ন, কতোদিন এই অন্তর্বর্তী বন্দোবস্ত? উত্তর খুঁজছেন সকলেই। বাংলাদেশের রাজনীতির নানান উত্থান-পতনের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব, সর্বত্রই একটা চাপা উত্তেজনার ছাপ। অনিশ্চয়তার উত্তেজনা। অনিশ্চয়তা নির্বাচন ও সরকারের মেয়াদকে ঘিরে। কেউ বলছেন, এক বছরেই ভোট। আবার কেউ বাজি ধরছেন, অন্তত ৪ বছর থাকবে এই সরকার। কিন্তু কী হবে? কবে হবে?
উত্তর খুঁজতে প্রথমেই উঁকি এনসিপি অফিসে। ঢাকার রূপায়ণ টাওয়ারের ১৬ তলায় তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির পার্টি অফিস। সেখানেই দেখা হলো, প্রাক্তন সমন্বয়ক এবং বর্তমানে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব লুৎফুর রহমানের সঙ্গে। তাঁর সাফ কথা, ‘বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে হারিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণ চাইছেন রাষ্ট্র সংস্কার। বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে। আমরা বিচার চাই। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা। আগে বিচার, পরে নির্বাচন।’ সরাসরি প্রশ্ন, আপনারা কি ভারত বিদ্বেষী? উত্তর, ‘মোটেই নয়। আমরা চাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব’। তবে ভারতীয় মিডিয়ার ‘অপপ্রচার’-এর বিরুদ্ধে অভিমান আছে কবির সুমনের ভক্ত এই তরুণ এনসিপি নেতার।
বিএনপি অফিসে দলের এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলেও তাঁর নামপ্রকাশে আপত্তি। ভারতীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাই বলতে চান না তিনি। তবু আতিথেয়তায় খামতি নেই। বললেন, ‘যা দেখছেন, তাই লিখুন।’ দল থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময়কার মতোই ভারতের সঙ্গে তাঁরা সুসম্পর্ক চান। পাকিস্তানের প্রতি তাঁদের আলাদা দরদ নেই। তাঁরা চান, দ্রুত নির্বাচন। মানুষও নাকি সেটাই চাইছেন। নির্বাচিত সরকার চান তাঁরা। এমনকি, আওয়ামি লিগ ভোটে লড়লেও তাঁদের আপত্তি নেই।
পরবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামের গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। আওয়ামি লিগের শাসনে তাঁরা ছিলেন কোনঠাসা। জামায়াতের সহকারী যুগ্ম মহাসচিব এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদের অবশ্য ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে কোনও আপত্তি নেই। খোলামেলা আলাপচারিতায় তিনি বোঝাবার চেষ্টা করলেন, জামায়াত মোটেই জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়। বরং সবধরনের হিংসার তাঁরা বিরোধী। দলের গঠনতন্ত্র ও সংবিধানের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, তাঁদের দলীয় নেতৃত্বের ৪০ শতাংশই নারী। তাই তাঁরা মোটেই নারী বিদ্বেষীও নন। হিন্দু ধর্মের প্রতিও তাঁদের কোনও বিদ্বেষ নেই। ইসলাম বিদ্বেষ বা হিংসাকে সমর্থন করে না। তাঁরা ভারত বিরোধী বা পাকিস্তান পন্থী, এটা অপপ্রচার বলে মনে করেন তিনি। তাঁর সাফ কথা, জামায়াতের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সর্বোচ্চ কৃতি সন্তান। জামায়াত তাই বাংলাদেশপন্থী।
জামায়াতেরই প্রচার সচিব মতিউর রহমান আকন্দ ভারত-সহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলেন। তবে তিস্তার জল, ফরাক্কা চুক্তি বা বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে যে তাঁদের ক্ষোভ রয়েছে সেটাও বুঝিয়ে দেন। চিনা কমিউিনস্ট পার্টির সঙ্গে বৈঠক করলেও উইঘুর মুসলিমদের দুর্দশায় তাঁরাও সমব্যথী। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়েও বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা শোনান তিনি। আকন্দ চাইছেন, সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি ভারতের মানুষদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষদের যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি করতে।
মানুষের আস্থা বাড়িয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসানে তিনি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও যোগাযোগ বাড়াতে চান। তাঁর মতে, বাংলাদেশে এখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ অটুট রাখতেই তিনি সংবিধান সংশোধনের কথা বলেন। তাঁরও সাফ্ কথা, জামায়াত হচ্ছে বাংলাদেশপন্থী। সংখ্যালঘু থেকে শুরু করে সকলের মঙ্গলেই কাজ করছে জামায়ত, সেটাই বোঝাতে চাইলেন তিনি। জানালেন, জামায়াত নিয়ে অপপ্রচারের অভাব নেই। দেশে ও বিদেশে অপপ্রচার চলছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী চিরকালই একটা বিরাট ভূমিকা রেখেছে। হাসিনা দেশছাড়ার সময়ও তাঁদের ভূমিকা চোখে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে গবেষক তথা প্রাক্তন সেনাকর্তা মেজর এ.এস.এম. সামছুল আরেফিনের মতে, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চিরকালই জনগণের পক্ষে থেকেছে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনও অস্ত্র হাতে তোলেনি। বাংলাদেশের ইতিহাস তাই বলছে। এবারও আমার মনে হয়, জনগণের ইচ্ছাকেই মর্যাদা দেবে সেনাবাহিনী’।
কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কী চাইছেন ? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। আপাতত আওয়ামি লিগের নেতাকর্মীরা হয় জেলে, না হয় আড়ালে। বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব লন্ডনে বসেই চাইছেন দ্রুত নির্বাচন। ড. ইউনূসের ইঙ্গিত বছর খানেকের মধ্যেই ভোট। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের দেওয়া ভোটের সময়সীমা শেষ হবে ডিসেম্বরে। এনসিপি বলছে, আগে সংস্কার, পরে ভোট। প্রায় একই মত জামায়াতেরও। ড. ইউনূসের সঙ্গীদের অনেকেরই মত আবার, আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকুক এই সরকার।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় বোঝা যায়, তাঁরা চাইছেন শান্তি। কর্মসংস্থান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। জঙ্গিদের হাত থেকে মুক্ত নিরাপদ আশ্রয়। দ্রব্যমূল্যে লাগাম। আইনের শাসন। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। সর্বোপরি দুবেলা দু-মুঠো ভাত। সঙ্গে অবশ্যই স্থায়িত্ব এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি। এটাই অলিখিত বাংলাদেশের দেওয়াল লিখন। এই চাহিদায় কোনও ধর্মীয় বিভেধ নেই। তাই ঢাকার রমনা, ঢাকেশ্বরী বা ইস্কন মন্দির থেকে শুরু করে জ্যোতি বসুর গ্রাম বারোদির লোকনাথ বাবার আশ্রমেও বোরখা পরা মুসলিম মহিলাদের পরিবর্তিত বাংলাদেশেও প্রার্থনা করার দৃশ্য মুছে যায়নি।